ভাবিনি কোনো দিন, শহরে এসে লেখাপড়া করার সুযোগ হবে আমার। বিরল থেকে দিনাজপুর— মাত্র কয়েক কিলোমিটারের দূরত্ব। মনে হতো কত দূরে। আমার পূজনীয় দেবগুরু আমাকে ভার্সিটি ভর্তি প্রস্তুতির জন্য এই দিনাজপুরেই এনে রেখেছেন। এখানে আমার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন রূপম স্যার। স্যারের উন্নয়ন সংস্থা ভাবনার অফিসে থাকছি। তিন বেলা খাবার পাওয়া এখনো কঠিন আমাদের জন্য। এখানে তিন বেলা ভরপেট খাওয়ার সময় ছোট বোনটার কথা মনে পড়ে। মায়ের মুখটা ভেসে উঠে চোখের সামনে। ভাই-ভাবির কথা ভাবি।
কোনোদিন দিনাজপুরে আসার কথা ভাবতে পারিনি আমি। আমাকে আমার দেবগুরু বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া লাগবেই। আমাদের কড়াদের মধ্যে সবচেয়ে উচ্চশিক্ষিত মানুষটা ছিলেন কৃষ্ণ কড়া। আমার কৃষ্ণ মামা। এসএসসিতে উত্তীর্ণ হতে পারেননি মামা। তবে আমাকে পড়তে বলেছেন সবসময়। তার সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে গেছেন আমাকে। আমাকে নিয়ে যে কৃষ্ণ মামার, আমাদের গ্রামের কড়াদের সবার অনেক স্বপ্ন।
সবার স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা করতে পারি যেন সেই চেষ্টায় সাহায্য করছেন আমার দেবগুরু আর রূপম স্যার। রূপম স্যার আমার শ্রদ্ধেয় দেবগুরুর ভায়রা ভাই। আমি যখন এইচএসসি পরীক্ষার ফ্রমফিলাপের সমস্যায় পড়ি। তখন আমার শ্রদ্ধেয় দেবগুরু, শ্রদ্ধেয় রূপম স্যার, সম্মানীয় মানিক সরেন ভাই এবং তাদের বন্ধু বান্ধবীরা মিলে আমার ফ্রমফিলাপের টাকা, যাতায়াতের জন্য একটি বাইসাকেল, বইপত্র কেনার জন্য এবং কোচিং করার জন্য আর্থিকভাবে সহযোগিতার ব্যবস্থা করে দেন। কিছু কিছু উপকার এমন হয়, সে উপকারের কাছে হাজার কোটি ধন্যবাদ ও তুচ্ছ মনে হয়। আমার লেখাপাড়ার জন্য এমনই উপকার করেছেন আমার পূজনীয় দেবগুরু, শ্রদ্ধেয় রূপম স্যার এবং শ্রদ্ধেয় মানিক সরেন ভাই। তাদের এই উপকারকে আমি কি বলে ধন্যবাদ জানাবো এই উপকারের সমতুল্য কোনো ভাষা খুঁজে পাই না আমি আমার মাঝে। এই সেদিন আমার পুরোনো মোবাইলটা নষ্ট হয়ে গেল। আমার গুরুদেবের বন্ধু মিলন স্যার একটা অনেক দামি মোবাইল কিনে দিলেন। সেই মোবাইলেই আমি লিখছি। ছবি তুলছি। শুধু ঈশ্বরের কাছে এই প্রার্থনা করি যে, হে ঈশ্বর পৃথিবীতে এই পরোপকারী মানুষদের দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
আমি এখন দিনজপুরের মাতাসাগর মোড়ে ভাবনা সামাজিক ও মানসিক কেন্দ্রে থেকে ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এখানে পরিচয় হলো রূপম স্যারের ছেলে অম্লান ভাইয়ের সঙ্গে। সে আমার ক্লাসমেট। শুধু কয়েক দিন হলো অম্লানের সঙ্গে। অম্লানের বন্ধু নাঈম ভাই, সেও আমার ক্লাসমেট। তারা দু জনই এত ভালো ছাত্র, তাদের নাম ধরে ডাকতে অনেক ভয় লাগে। অম্লান ভাই ও নাঈম ভাই দু জনই আমাকে ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষার জন্য যথেষ্ট ভালো পরামর্শ দেন। ভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারব এমন আশা করতেও আমার ভয় লাগছে। যদি পারি, তাহলে কড়াদের অনেক কাজে লাগব নিশ্চয়ই। কড়া জাতিটা তো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তাদেরকে এই দেশে ধরে রাখতে পারব। প্রতিদিন কত নির্যাতন যে আমাদের সইতে হয়। নির্যাতিত হয়ে কড়ারা বহু বছর ধরে দেশ ছেড়ে যাচ্ছে। আজকে আমি যে মাতাসাগরে থেকে ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি, শুনেছি এই মাতাসাগরেই আমাদের কড়া সম্প্রদায়ের অনেক পরিবার বসবাস করতো। খোঁজ নিয়ে শেষ তিনটি পরিবারের কথা জানতে পেরেছি আমি। শিশু কড়া, শিঙ্গা কড়া আর সহরিয়া কড়া। এই তিন জন তাদের পরিবার নিয়ে মাতাসাগরে বসবাস করতেন। মাতা সাগর পুকুরের পূর্ব পাড়ে এই তিন পরিবার বসবাস ছিল। শুনেছি মাতাসাগর পুকুরের পূর্ব পার্শ্বে যেখানে এখন ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে, সে স্থানে এই তিন পরিবারের আবাসস্থল ছিল। কী কারণে এখান থেকে কড়ারা হারিয়ে গেছে, তা জানতে পারিনি। বাংলাদেশ থেকে আমরা বাংলা ভাষা কে হারিয়ে যেতে দিইনি। আজ আমরা কড়া সম্প্রদায়ের মানুষেরা নিজের জাতিকে হারাতে বসেছি। এই বেদনা বলার মতো ভাষা আমার জানা নেই। মাতাসাগরে যদি কড়ারা থাকত আমি তাদের কাছে যেতাম, নিজের ভাষায় কথা বলতাম। আজকে আমরা কড়ারা কড়া ভাষাসহ নিজের জাতিকে হারাতে বসেছি। আমরা রক্ত দিয়েও নিজের সম্প্রদায়ের মানুষদেরকে ধরে রাখতে পারিনি। কারণ আমরা হলাম সংখ্যালঘু। আমরা রক্ত দিয়েছি, মা বোনের সম্মান হারিয়েছি, কয়েক জনের জীবনও গিয়েছে নির্যাতনের শিকার হয়ে। তবুও নিজের সম্প্রদায়কে ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছি। কারণ আমরা সংখ্যালঘু।
আপনার মতামত লিখুন :