বশেমুরবিপ্রবির পর্যটন এবং আতিথেয়তা ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষা সফর সম্পন্ন


প্রকাশের সময় : জুলাই ৩, ২০২২, ৩:১৮ অপরাহ্ন / ৬৬২
বশেমুরবিপ্রবির  পর্যটন এবং আতিথেয়তা  ব্যবস্থাপনা বিভাগের  শিক্ষা সফর সম্পন্ন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরবিপ্রবি) এর পর্যটন এবং আতিথেয়তা ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষা সফর-২০২২ সম্পন্ন হল। বিভাগের ৩ জন শিক্ষক ও ৬৬ শিক্ষার্থী (মোট ৬৯জন) নিয়ে ৫ রাত ৪ দিনের সফরে ভ্রমণের জায়গা ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান এর বেশ কিছু রোমাঞ্চকর জায়গা। তবে সব ছাপিয়ে গিয়েছে ৬৯ জন মানুষের কেওক্রাডং জয়ের গল্প।

ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা বলেন, আমরা চাঁদের গাড়ি করে যতই বগালেকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, ততই যেন সবাই পাহাড়ের নেশায় বুদ হয়ে যাচ্ছিলো। উঁচু উঁচু খাড়া পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে গন্তব্যে যাওয়ার সময় শুরু হয় ঝুম বৃষ্টি আর বৃষ্টি শেষ না হতেই পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে শুরু হয় মেঘের লুকোচুরি খেলা। আমরা বৃষ্টিবিলাস শেষ করে আবারো বগাকাইন লেকের উদ্দেশ্য রওনা দেয়।পথিমধ্যে আমাদের একটি চাঁদের গাড়ি পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে নামার সময় চাকা ও ব্রেকজনিত সমস্যার সম্মুখীন হয়, চালকের দক্ষতায় আমরা কোন বিপদের সম্মুখীন হয়নি। পরে তাদের অন্য চাঁদের গাড়িতে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

সব চেকিং, প্রতিকূল পরিবেশ পেরিয়ে আমরা ২৮ জুন বিকাল ৪টায় বগালেক পৌঁছায়।সেদিন আর কেওক্রাডং যাওয়া হয়নি।আমাদের শিক্ষক ও শিক্ষিকারা সিদ্ধান্ত নেন এবং বগালেক থেকে যান।তারপর বগালেকে গোসল, রাতে সাংস্কৃতি অনুষ্ঠান, ক্যাম্প ফায়ার।আমাদের সাথে পাড়ার লোকজনও আনন্দে মেতেছিল। বগাকাইন বা বগালেকের মজার একটি বিষয় প্রতিবছর এই লেকের পানির রঙ পরিবর্তন হয়।

পরদিন ২৯ জুন ভোর ৬ টায় আমরা কেওক্রাডং এর উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।নির্মল শুভ্র সকালে শুরু হয় আমাদের অভিযান।কিন্তু আগের দিনের বৃষ্টির কারণে পাহাড়ি মাটির রাস্তা বিশেষ করে পাথুরে রাস্তাগুলো অত্যাধিক পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছিল। যা আমাদের অভিযানকে আরো বিপদজনক ও রোমাঞ্চকর করে তুলেছিল।চিংড়ি ঝর্ণা গিয়ে অনেকেই একটু মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। তবে যেহেতু আমরা ট্যুরিজমের শিক্ষার্থী, এসব ব্যাপারে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আছে। তাই আমরা দৃঢ় মনোবল নিয়ে আবারো যাত্রা শুরু করি। এ ব্যাপারে আমাদের শিক্ষকমন্ডলী আমাদের অনেক অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।

পথিমধ্যে অনেকেই জোকের শিকার হয়, অনেকের রক্তপাত থামানোই যাচ্ছিলোনা। পিচ্ছিল রাস্তা থাকায় অনেকে পা মচকানোর মতো অবস্থায় পড়ে।আমাদের কাছে আগে থেকেই সব ধরনের ওষুধ, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছিল। তাই আমাদের চলার পথে কষ্ট হলেও কোনো ঝামেলা পোহাতে হয়নি।আমদের গাইড বেলাল, রাহাত, ইসমাঈল সাহেব তারাও বেশ বন্ধুসুলভ ছিলেন।

৬৯ জন মানুষ নিয়ে কেওক্রাডং এর চূড়ায় পৌছানো ছিল খুবই রোমাঞ্চকর। অনেকেরই এটা প্রথম ট্রেকিং ছিল পাহাড়ে। স্যার, ম্যাম, গাইড শিক্ষার্থীদের প্রচেষ্টা, সহযোগিতা সব মিলিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম কেওক্রাডং পর্বতের চূড়ায়। কেওক্রাডং পর্বতের চূড়ায় উঠে যেন আমাদের ক্লান্তি, কষ্ট, সকল অভিযোগ একেবারেই মুছে গেল। চারিদিকে মেঘের ছোটাছুটি। মেঘ যেন চাচ্ছিলো আমাদের মধ্যে প্রবেশ করে আমাদের বশ করতে।

এ ব্যাপারে ট্যুরিজম বিভাগের চেয়ারম্যান সহকারী অধ্যাপক বাপন চদ্র কুরী বলেন, “আমাদের সফরের মূল বিষয় ছিল পাহাড়ে বসবাসরত মানুষের জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা, প্রতিকূল পরিবেশ নিজেকে মানিয়ে নেওয়া এবং এডভেঞ্চার ট্যুরিজম সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের হাতে কলমে শিখানো। এটা সত্যিই আমাদের জন্য একটি বড় সাফল্য।এত সুন্দর নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করা, মেঘের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া, এক সময়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় আরোহন করা, সব মিলিয়ে অসাধারণ।”

কেওক্রাডং জয় ছাড়াও এই ট্যুরের অংশ হিসেবে রাঙামাটির কাপ্তাই লেক, শুভলং ঝর্ণা, ঝুলন্ত সেতু, বান্দরবানের নীলাচল, রুমা, মুনলাই পাড়া, দার্জিলিং পাড়া ঘুরে দেখা হয়। তবে এভাবে এত মানুষ নিয়ে, এত ধরনের মানুষ নিয়ে কেওক্রাডং উঠতে পারা সত্যিই চ্যালেঞ্জিং ছিল। একটা মানুষ ও বাদ যায়নি কেওক্রাডং জয় করতে। যা আসলেই একটা বড় সাফল্য আমাদের জন্য।

এ বিষয়ে ট্যুরিজম বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাদিয়া আফরিন অনন্যা বলেন, “২৬ তারিখ ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্ট থেকে আমরা ৩ জন শিক্ষক এবং ৬৬ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু করি রাঙ্গামাটি এবং বান্দরবানের পথে। যেখানে আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল কেওক্রাডং জয় করা। আসলে ৩১৭২ ফুট উচ্চতার এ পাহাড় জয়ের অভিজ্ঞতার কথা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। সত্যি বলতে মনে একটা সংশয় কাজ করছিল যে এই ৬৯ জন কি আসলেই পারবে এই পর্বত শৃঙ্গ জয় করতে ! কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীদের উৎসাহ উদ্দীপনার কাছে এই সংশয় হার মেনে গিয়েছে। তারা যেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার। মেঘে ঢাকা এ পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে মনে হয়েছে আমাদের এ ট্রেকিং স্বার্থক। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এত ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে কেওক্রাডং জয় এই প্রথম। আমরা আসলেই আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে নিয়ে গর্বিত।”

এই শিক্ষা সফর শুধু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একটি বড় প্রাপ্তি নয় পুরো জীবনের একটি বড় প্রাপ্তি হয়ে থাকবে এবং যা আমাদের নতুনভাবে দেশ-বিদেশ সম্পর্কে জানতে অনুপ্রেরণা দেবে।

শিক্ষাসফর শুধু আনন্দ নয় আমাদের পাহাড়ি জনবসতির আচার-আচরণ, সংস্কৃতি, ধর্ম, জীবন-যাপনের ধরন, উৎসব সম্পর্কে অবগত হওয়ার বড় সুযোগ দিয়েছে।তাদের জীবনমান উন্নয়নের পথের সংকীর্ণতা, শিক্ষার উন্নয়ন সম্পর্কে একটি বাস্তব ধারণা দেয়।

এ বিষয়ে ট্যুরিজম বিভাগের লেকচারার সিনথিয়া ইসলাম বলেন,”এই শিক্ষাসফর আমাদের ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট এর জন্য অনেক বড় একটা অর্জন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৯ জনের এতো বড় দল নিয়ে কেওক্রাডং বিজয় এই প্রথম। আমাদের পরিকল্পনা ছিল রাঙামাটি ও বান্দরবান এর পথে। আর সব থেকে বড় এবং শেষ গন্তব্য ছিল আমাদের কেওক্রাডং ট্রেকিং। পাহাড়ে বসবাসরত মানুষের জীবন, জীবিকা, সংস্কৃতি নিয়ে জানা এবং বাংলাদেশের ট্যুরিজম সম্পদ এর উন্নতির পথে সম্ভাবনা, বাধা ও প্রতিকূলতা গুলো বের করে আনাই ছিল তাদের এতো বড় সফরের উদ্দেশ্য। এটা নিয়ে প্রথম থেকেই আমরা একটু চিন্তিত ছিলাম যে এতো লম্বা যাত্রা আমাদের শিক্ষার্থীরা পার করতে পারবে কিনা , আর যে পথে রয়েছে অনেক প্রতিকূলতা। কিন্তু আমাদের সাহস ও বিশ্বাস যেন তারা প্রতিটা পদক্ষেপে বাড়িয়ে দিয়েছে। অসম্ভবকে সম্ভব করার দৃঢ় মনোবল ছিল আমাদের প্রত্যেকটি ছাত্র ছাত্রীর মধ্যে। সব ধরণের বাধাকে জয় করে তারা ৩১৭২ ফুট উপরে পারি জমায় এবং নিজের বিভাগের জন্য ইতিহাস তৈরী করে এসেছে। একই সাথে তারা যেমন উদ্যমী, সাহসী, মনোবল দৃঢ়, পরিশ্রমী, চঞ্চল, নিডর, নির্ভীক। তেমনি অন্যদিকে তারা বিনয়ী, ভদ্র, উদার, নম্র। কেওক্রাডং এর চূড়ায় থাকা সীমান্ত প্রহরীরা পর্যন্ত তাদের সাহস ও শক্তি দেখে অবাক ছিল। কেওক্রাডং এর অবর্ণনীয় নৈসর্গিক সৌন্দর্য সব ধরণের কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। মেঘের রাজ্যে আমাদের শিক্ষার্থীরা তাদের প্রথম শিক্ষাসফরকে সফল করে এসেছে। ট্যুরিজম পরিবার এই শিক্ষার্থীদের নাম সবসময় গর্বের সাথে মনে করবে।”