বাড়ির পাশের জঙ্গলগুলো নেই


প্রকাশের সময় : অক্টোবর ১৪, ২০২০, ২:০৪ পূর্বাহ্ন / ২৯৭
বাড়ির পাশের জঙ্গলগুলো নেই

কাপল কড়াঃ

আমাদের বাড়ির পাশে দুটি মাঠ আছে। মাঠগুলো একসময় জঙ্গল ছিল। ওই জঙ্গল দুটির গল্প আমি শুনেছি দাদির কাছে। আমি আমার দাদুকে দেখিনি। দাদু মারা যান যখন, তখন আমার জন্মই হয়নি। দাদিকে পেয়েছি। ছোটবেলায় আমি প্রায়ই দাদির কাছে বসে গল্প শুনতাম। দাদি বলতেন, আমাদের বাড়িটা ছিল ঝিনাইকুড়ি হালজায় গ্রামের মাঝ বরাবর। বাইরে থেকে আমাদের বাড়িতে আসতে হলে অনেক অলি-গলি পার হয়ে আসতে হতো। এখন পাড়ার এ প্রান্ত থেকে পাড়ার শেষ প্রান্ত দেখা যাচ্ছে। দাদির গল্প অন্য একদিন বলব। দাদির কথা মনে এল আমাদের গ্রামটা কেমন করে শূন্য হয়ে যাচ্ছে, তা ভাবতে গিয়ে। কড়াদের শেষ কয়েকটি পরিবারের কথা ভাবতে গিয়ে। তার আগে সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছি কিভাবে কড়াদের বাংলাদেশে আগমন ঘটেছিল। বৃদ্ধ গুরুজনদের কাছ থেকে শুনেছি, আমাদের আদি পুরুষরা ভারতের ঝাড়খণ্ড, দুমকা ইত্যাদি জায়গায় বসবাস করতেন। রেলপথ তৈরি করার সময়, রেলপথ তৈরি করতে করতে আমাদের পূর্র পুরুষরা এই দেশের মাটিতে পা রাখেন। পরে আর ফিরে যাননি কেউ কেউ। সে কত দিন আগের তা আমিও জানি না। কারণ দাদির কাছে শুনেছি ভারত-পাকিস্তান যখন ভাগ হয়, সেই সময়ে আমাদের গ্রাম ছিল কড়া পরিবারে পরিপূর্ণ। কত কাল আগে কড়া জাতি বর্তমান বাংলাদেশে এসেছে তা সঠিকভাবে জানতে পারিনি আমি। কড়ারা এখানে সুখে শান্তিতে বসবাস করা শুরু করলেও সে সুখশান্তি বেশি দিন টিকে থাকেনি। তাদের জমিজমা, সম্পদের ওপর নজর পড়ে যায় স্থানীয় প্রভাবশালীদের। পরবর্তীকাল থেকে তাদের ওপর শুরু হয় নির্যাতন। জোর করে, ঠকিয়ে আমাদের পূর্বপুরুষদের সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া শুরু হয়। জমি ছেড়ে দিতে না চাইলে যেখানে, সেখানে আটক করে মারধর শুরু করে।মেরে ফেলার হুমকি দেয়। এই অন্যায়, নির্যাতনের শিকার হয়ে, মৃত্যুর ভয়ে, ভারতে পাড়ি দিতে শুরু করে কড়া পরিবারগুলো। সে দিন থেকে শুরু করে আজও আমাদের ওপর নির্যাতন করে চলেছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। গত বছর ২০১৯ সালের ৬ মার্চ স্থানীয় ভূমিদস্যুরা রাক্ষসের মতো হামলা করে আমাদের ওপর। আমাদের মা-বোনের সম্মানহানি করে। হাসুয়া, দা, চাকু, লাঠিসহ ভারি ভারি অস্ত্র দিয়ে আমাদেরকে রক্তাক্ত করে। মা-বোনদেরকে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দেয়। মা- বোনদের সম্ভ্রমে হাত দেয়। ঘরবাড়ি ভাঙচুর করে। তিন মাসের একটি শিশুর বুকে পা তুলে দেয় হত্যার উদ্দেশে। শিশুটি নাকি তাদের কাল। শিশুটির মা ভূমিদস্যুর পা ধরে শিশুটিকে রক্ষা করে। এখানে টিকে থাকতে অনেক অন্যায়, অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে আমাদের। শুনেছি পূর্ব-পুরুষেরা বনজঙ্গল পরিষ্কার করে, বাঘ-ভাল্লুক তাড়িয়ে, বিভিন্ন জীবজন্তুর সঙ্গে যুদ্ধ করে এখানে বসবাস শুরু করেছিল। কত সুন্দর ছিল সেদিনের কড়া গ্রামগুলো?
দাদির গল্পে সেই সুন্দর গ্রামগুলোর ছবি দেখতে পেতাম ছোটবেলায়। তবে দাদির গল্পে ফিরে ফিরে আসত জঙ্গলের গল্প। জঙ্গল যে আমাদের জীবন। বনের পশু শিকার করে খাবার সংগ্রহ করতে কোনো বেগ পাওয়া লাগত না। জঙ্গলের গল্প শুনলেই আমার মনে হতো দাদার আমলটা কত ভালো ছিল। বাবাও ওই জঙ্গলের অনেক কিছু দেখেছে বলে শুনেছি। জঙ্গলগুলোর একটির নাম ছিল হেরণা বিল আর অন্যটির নাম বেলকুড়ি। হেরণা বিলে হরিণ পানি খাওয়ার জন্য আসত। তাই সে জায়গার নাম হয় হেরণা বিল। আমরা ছোটবেলায় ছেলে-মেয়েরা মিলে সেখানে গরুকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে যেতাম। হেরণা বিলে একটা অনেক বড় মহুয়া ফলের গাছ ছিল। ওই গাছটার কথা মনে এলে এখনো আমার মন কেমন করে। গরুগুলোকে ঘাস খাওয়ার জন্য ছেড়ে দিয়ে মহুয়া গাছের নিছে খেলা করতাম আমরা। মহুয়া ফল কুড়িয়ে খেতাম। হেরণা বিলের পাশেই বেলকুড়ি। কখনো কখনো সে দিকেও গরুকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে যেতাম। বেলকুড়িতে বেল গাছ প্রচুর ছিল। সেখানকার বেল অনেক বড় বড় হতো। খেতেও অনেক স্বাদের ছিল। তখন আমাদের গ্রামের পূর্বপাশে বড় দুটি শিমূল গাছ আর একটি বড় আম গাছ ছিল। সেই গাছের আম দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি খেতেও মধুর মতো মিষ্টি ছিল। এখন চারদিকে শুধু ফাঁকা মাঠ। আর কোথাও কোথাও লিচুর বাগান হয়েছে। সে কালের কোনো চিহ্ন নেই আজ। প্রকৃতির কত পরিবর্তন হয়েছে। জানি না একশত বছর পর এই গ্রামে দৃশ্য কী রূপ ধারণ করবে? এই গ্রামের চিত্র দেখতে কেমন হবে? কড়ারা কি থাকতে পারবে এই গ্রামে, এই দেশে?
ভূমিদস্যু আর স্থানীয় প্রভাবশালীদের অন্যায় অত্যাচারের পর শেষ ১৬ টি পরিবার টিকে ছিল। দুই তরুণের বিয়া হওয়ায় পরিবারের সংখ্যা হয় ১৮টি। বর্তমানে আমাদের গ্রামে পরিবারের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৪টি। এক জন তরুণীর বিয়ে হয়েছে এবং সে এই গ্রামেই থাকে। অন্য পাঁচটি পরিবার আলাদা হয়েছে অর্থাৎ এখন আলাদা খাওয়া-দাওয়া করে। তাই আমার মনে হলো পরিবারের সংখ্যা ২৪টি বলাই ভালো। শুনেছি চকফসল, রানীপুকুর, মাতাসাগর, ঘুঘুডাঙ্গা ইত্যাদি গ্রামে অনেক কড়া পরিবার বাস করতো। এখন আমাদের গ্রামের ২৪টি পরিবার ছাড়া ঘুঘুডাঙ্গায় আরো দুটি পরিবার বাস করে। চকফসলে শুধু একজন বৃদ্ধা একাই ছিলেন। তার ছেলেরা ভারতে চলে যায়। আর ফিরে আসেনি। স্বামী মারা যাওয়ার আমাদের গ্রামের লোকজন বৃদ্ধাকে আমাদের গ্রাম ঝিনাইকুড়ি হালজায়তে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। একাই চকফসলে বাস করতেন তিনি। কয়েক বছর আগে তার মৃত্যুর সঙ্গে চকফসল কড়া শূন্য হয়ে গেছে। ভয় হয়, আমাদের গ্রামের কী হয়?